জীবের বৃদ্ধি ও পরিস্ফুটন নির্ভর করে কোষ বিভাজনের ওপর।
প্রতিটি জীবদেহ কোষ (Cell) দিয়ে তৈরি।যে প্রক্রিয়ায় জীবের বৃদ্ধি ও প্রজননের উদ্দেশ্যে কোষ বিভাজনের (cell division) মাধ্যমে কোষের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে তাকে কোষ বিভাজন বলে।
কোষ বিভাজনের প্রকারভেদঃ
•অ্যামাইটোসিস বা প্রত্যক্ষ কোষ বিভাজনঃযে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি মাতৃকোষ নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম এর বিভাজন ছাড়াই সরাসরি বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য কোষ সৃষ্টি করে তাকে অ্যামাইটোসিস কোষ বিভাজন বলে।ইস্ট,ব্যাকটেরিয়া,নীলাভ সবুজ শৈবাল,অ্যামিবা ইত্যাদি এককোষী জীবে অ্যামাইটোসিস কোষ বিভাজন ঘটে।
জীবদেহের দুইটি গুরুত্বপূর্ণ কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া হচ্ছ
মাইটোসিস (Mitosis) এবং মিয়োসিস (Meiosis)।
মাইটোসিস বা সমীকরণমূলক বিভাজন: যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় সাইটোপ্লাজম ও নিউক্লিয়াস উভয়ই একবার করে বিভাজন হয় তাকে মাইটোসিস কোষ বিভাজন বলে। সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহকোষে এ ধরনের বিভাজন সংঘটিত হয়।
মিয়োসিস বা হ্রাসমূলক বিভাজন: যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় সাইটোপ্লাজম একবার ও নিউক্লিয়াস দুইবার বিভাজিত হয় তাকে miyosis কোষ বিভাজন বলে। সাধারণত উদ্ভিদ ও প্রাণীর জননকোষে এ বিভাজন হয়ে থাকে।
কোষচক্রঃ একটি বর্ধিষ্ণু কোষের জীবন শুরু হয় মাতৃকোষের বিভাজনের মাধ্যমে এবং শেষও হয় বিভাজিত হয়ে অপত্য কোষ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। কোষের এ বৃদ্ধির বিভিন্ন পর্যায় চক্রাকারে সম্পন্ন হয়। কোষ সৃষ্টি, এর বৃদ্ধি এবং পরবর্তীতে বিভাজন- এ তিনটি কাজ যে চক্রের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তাকে কোষচক্র বলে। হাওয়ার্ড ও পেজ (Howard & Pele, 1953) কোষচক্রের প্রস্তাব করেন। চক্রটিকে তাই হাওয়ার্ড-পেক্ষ কোষচক্রও বলা হয়। মানবদেহে কোষচক্রের সময়কাল প্রায় ২৪ ঘণ্টা, ঈস্টকোষে এই সময়কাল ১০ মিনিট। বিভাজনের জন্য অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সংকেত (signal)-এর প্রয়োজন হয়। সব কোষই বিভাজনক্ষম এমন নয়। যেমন-পেশিকোষ, স্নায়ুকোষ, লোহিত রক্ত কণিকা, উদ্ভিদের স্থায়ী কোষসমূহ ইত্যাদি বিভাজিত হতে পারে না। আবার কিছু কোষ দ্রুত বিভাজনে সক্ষম, যেমন- ভ্রূণকোষ, মূল ও কান্ডের মেরিস্টেম কোষ এই কোষচক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। কোষচক্রের প্রধান দুটি ধাপ রয়েছে
(ক) ইন্টারফেজ এবং (খ) মাইটোটিক ফেজ
নিচে এদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়া হলো ।
ইন্টারফেজঃ মাইটোসিস কোষ বিভাজন শুরু করার প্রভৃতি পর্বকে ইন্টারফেজ বলে। এটি একটি কোষের পরপর দুই বিভাজনের মধ্যবর্তী সময়। এ অধ্যায়টি কোষচক্রের ৯০-৯৫ ভাগ সময় জুড়ে চলে থাকে। পরবর্তী মাইটোটিক ফেজ-এর প্রয়োজনীয় বিভিন্ন রাসায়নিক পরিবর্তনের এক ব্যাপক বিপাকীয় কর্মকান্ড ইন্টারফেজে ঘটে। ইন্টারফেজ দশার স্থায়িত্বকাল অন্যান্য দশার চেয়ে বেশি। যেমন-মানুষের কোষ বিভাজনের মোট সময়কাল ২৪ ঘণ্টা, সেক্ষেত্রে ইন্টারফেজে ব্যয় হয় ২৩ ঘন্টা। ইন্টারফেজ দশার বিভিন্ন পরিবর্তনকে মোট তিনটি উপধাপ বা উপপর্যায়ে বিভক্ত করা যায়।
• G (Gap-1) ফেজঃ এটি ইন্টারফেজ পর্বের প্রথম উপপর্যায়। একটি কোষ পরবর্তীতে বিভাজন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করবে কিনা, তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় G, উপপর্যায়ে কোষটি মাইটোটিক কোষ বিভাজনের জন্য উপযুক্ত হলে সেখানে সাইক্লিন নামক এক বিশেষ প্রোটিন তৈরি হয় যা Cdk (Cyclin dependent Kinase)-এর সাথে যুক্ত হয়ে সমগ্র প্রক্রিয়ার গতি ত্বরান্বিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। Cdk ফসফোরাইলেশন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। এ সময় প্রয়োজনীয় অন্যান্য প্রোটিন, RNA এবং DNA প্রতিলিপনের (রেপ্লিকেশন) সব উপাদান তৈরি হয়। কোষটি আকৃতিতে বড় হয় এবং নিউক্লিয়াসের আকার বৃদ্ধি পেতে থাকে। মোট কোষচক্রের ৩০-৪০% সময় এই উপপর্যায়ে ব্যয় হয়।
• S-ফেজঃ S=Synthesis অর্থাৎ সংশ্লেষণ S-ফেজকে DNA সংশ্লেষণ পর্যায় বলা হয়। এ পর্যায়ে DNA অণুর প্রতিলিপন ঘটে । একটি দ্বিতন্ত্রী DNA অণু দৈর্ঘ্য বরাবর দুটি দ্বিতস্ত্রী অণুতে পরিণত হয়। প্রতিটি ডিপ্লয়েড কোষে DNA-এর পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে যায়। এসময় হিস্টোন প্রোটিন সংশ্লেষ হয়।
• G (Gap-2) ফেজঃ পর্যায়ের পর মাইটোটিক ফেজ শুরু হওয়া পর্যন্ত সময়কে G, ফেজ বলে। এসময় নিউক্লিয়াসের আয়তন বেড়ে যায় এবং স্পিন্ডল তন্তু তৈরির জন্য মাইক্রোটিউবিউল গঠনকারী পদার্থের সংশ্লেষণ ঘটে। প্রাণিকোষে সেন্ট্রোজোমটি বিভাজিত হয়ে দুটি সেন্ট্রোজোমে পরিণত হয়। সেন্ট্রোজোম মাইক্রোটিউবিউলস তৈরির সূচনা করে। কোষ এ সময় প্রচুর ATP ও প্রয়োজনীয়, প্রোটিন অণুতে পূর্ণ থাকে। মোট সময়ের ১০-২০% এ উপপর্যায়ে বায় হয়। G থেকে মাইটোসিসে প্রবেশ করতে হলে ম্যাচুরেশন প্রোমোটিং ফ্যাক্টর (MPF) নামক প্রোটিনের প্রয়োজন পড়ে।
খ. M-ফেজ (M-phase) বা মাইটোটিক ফেজঃ এ অধ্যায়ে মাইটোসিসের মূল ভৌত বিষয়টি সম্পন্ন হয়। জটিল এ প্রক্রিয়াটি নিউক্লিয়াসের বিভাজন ও পুনঃগঠন, নতুন দুটি কোষে সাইটোপ্লাজমের গমন, কোষঝিল্লি ও কোষপ্রাচীর (উদ্ভিদকোষে) গঠনের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটায়। কোষচক্রের মোট সময়ের মাত্র ৫-১০ ভাগ সময় এ পর্যায়ে ব্যয় হয়। এভাবেই ইন্টারফেজ → M-ফেজ → ইন্টারফেজ চক্রাকারে চলতে থাকে ।
ইন্টারফেজ-এর গুরুত্বঃ পূর্বে ইন্টারফেজ ধাপকে বিশ্রাম অবস্থা হিসেবে ধারণা করা হলেও ১৯৫০ এর দিকে জানা যায় এটি একটি সক্রিয় ধাপ। নিচে জীবের জীবনে ইন্টারফেজের গুরুত্ব উল্লেখ করা হলো।
* কোষ বিভাজনের পূর্বশর্ত হচ্ছে ইন্টারফেজ। এ পর্বটি সম্পন্ন না হলে কোষবিভাজন ঘটবেনা । কোষ বিভাজন না ঘটলে কোষের সংখ্যাবৃদ্ধি হবে না ফলে জীবদেহ পূর্ণাঙ্গতা লাভ করবে না অর্থাৎ নতুন জীব সৃষ্টি হবে না ।
* কোষের স্বাভাবিক কর্মকান্ড সম্পাদনসহ কোষের বৃদ্ধি এবং বিভাজনের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রোটিন এবং নিউক্লিক এসিড উপাদান ইন্টারফেজ ধাপেই সংশ্লেষ হয়।
* এ ধাপেই DNA প্রতিলিপন (রেপ্লিকেশন) ঘটে ।
* কোষ বিভাজনের প্রয়োজনীয় শক্তি (ATP) তৈরি হয়।
* কোষ বিভাজনের প্রয়োজনীয় স্পিন্ডল তন্তু তৈরির জন্য মাইক্রোটিউবিউলস সৃষ্টি হয়।
* কোষটি পরবর্তী কোষ বিভাজনে অংশগ্রহণ করবে কিনা তা ইন্টারফেজ-এর প্রথম দিকেই নির্ধারিত হয়।
মাইটোসিস (Mitosis) কোষ বিভাজনঃ
এই কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় প্রকৃত বা সুকেন্দ্রিক কোষ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য কোষে পরিণত হয়। মাইটোসিস কোষ বিভাজনে নিউক্লিয়াস ও সাইটোপ্লাজম একবার করে বিভাজিত হয়। তাই মাইটোসিস বিভাজনে কোষের মাতৃকোষ এবং অপত্য কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা, সমান থাকে। একে সমীকরণিক বিভাজনও বলে।
এই বিভাজন প্রকৃত নিউক্লিয়াসযুক্ত জীবের দেহকোষে (somatic cell) হয়ে থাকে এবং বিভাজনের ফলে কোষের সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাণী এবং উদ্ভিদ দৈর্ঘ্যে এবং প্রস্থে বৃদ্ধি পায়। প্রাণীর দেহকোষে এবং উদ্ভিদের বর্ধনশীল অংশের ভাজক টিস্যু, যেমন: কাণ্ড, মূলের অগ্রভাগ, ভূণমুকুল এবং ভ্রূণমূল, বর্ধনশীল পাতা, মুকুল ইত্যাদিতে মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজন হয়। নিম্নশ্রেণির উদ্ভিদ এবং প্রাণীর অযৌন জননের সময়ও এ ধরনের বিভাজন হয়।
মাইটোসিসের পর্যায়সমূহ (Stages of Mitosis):
এই বিভাজনে প্রথমে ক্যারিওকাইনেসিস অর্থাৎ নিউক্লিয়াসের বিভাজন ঘটে এবং পরবর্তীকালে সাইটোকাইনেসিস অর্থাৎ সাইটোপ্লাজমের বিভাজন ঘটে। বিভাজন শুরুর আগে কোষের নিউক্লিয়াসে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ হয়। এ অবস্থাকে ইন্টারফেজ পর্যায় বলে। মাইটোসিসের নিউক্লিয়াসের বিভাজন প্রক্রিয়াকে পাঁচটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়ে থাকে।পর্যায়গুলো হচ্ছেঃ
•প্রোফেজ (Prophase):
*এটি মাইটোসিসের প্রথম পর্যায়।
*এ পর্যায়ে কোষের নিউক্লিয়াস আকারে বড় হয় এবং ক্রোমোজোম থেকে পানি হ্রাস পেতে থাকে।
এর ফলে ক্রোমোজোমগুলো আস্তে আস্তে সংকুচিত হয়ে মোটা এবং খাটো হতে শুরু করে।
*এ পর্যায়ে প্রতিটি ক্রোমোজোম সেন্ট্রোমিয়ার ব্যতীত লম্বালম্বি দুভাবে বিভক্ত হয়ে দুটি ক্রোমাটিড উৎপন্ন করে।
*ক্রোমোজোমগুলো কুণ্ডলিত অবস্থায় থাকায় এদের সংখ্যা গণনা করা যায় না।
•প্রো-মেটাফেজ (Pro-metaphase):
*এ পর্যায়ের একেবারে প্রথম দিকে উদ্ভিদকোষে কতগুলো তন্তুময় প্রোটিনের সমন্বয়ে দুই মেরু বিশিষ্ট পিন্ডল যন্ত্রের (spindle apparatus) সৃষ্টি হয়।
স্পিন্ডল যন্ত্রের দুই মেরুর মধ্যবর্তী স্থানকে ইকুয়েটর বা বিষুবীয় অঞ্চল বলা হয়।
*কোষকঙ্কালের মাইক্রোটিবিউল দিয়ে তৈরি স্পিন্ডলযন্ত্রের তন্তুগুলো এক মেরু থেকে অপর মেরু পর্যন্ত বিস্তৃত, এদেরকে স্পিন্ডল তন্তু (spindle fibre) বলা হয়।
*এ পর্যায়ে ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার স্পিন্ডলযন্ত্রের কিছু নির্দিষ্ট তন্তুর সাথে সংযুক্ত হয়। এই তন্তুগুলোকে আকর্ষণ তন্তু (traction fibre) বলা হয়। ক্রোমোজোমের সাথে এই তন্তুগুলি সংযুক্ত বলে এদের ক্রোমোসোমাল তন্তুও বলা হয়।
ক্রোমোজোমগুলো এ সময়ে বিষুবীয় অঞ্চলে বিন্যস্ত হতে থাকে।
*কোষের নিউক্লিয়াসের নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ও নিউক্লিওলাসের বিলুপ্তি ঘটতে থাকে।
*প্রাণিকোষে স্পিন্ডল যত্র সৃষ্টি ছাড়াও পূর্বে বিভক্ত সেন্ট্রিওল দুটি দুই মেরুতে অবস্থান করে এবং সেন্ট্রিওল দুটির চারদিক থেকে রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। একে অ্যাস্টার-রে বলে।
•মেটাফেজ (Metaphase):
*এ পর্যায়ের প্রথমেই সব ক্রোমোজোম স্পিন্ডল যন্ত্রের বিষুবীয় অঞ্চলে (দুই মেরুর মধ্যখানে) অবস্থান করে।
*প্রতিটি ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার বিষুবীয় অঞ্চলে এবং বাহু দুটি মেরুমুখী হয়ে অবস্থান করে।
*এ পর্যায়ে ক্রোমোজোমগুলো সর্বাধিক মোটা এবং খাটো হয়।
*প্রতিটি ক্রোমোজোমের ক্রোমাটিড দুটির আকর্ষণ কমে যায় এবং বিকর্ষণ শুরু হয়।
*এ পর্যায়ের শেষ দিকে সেন্ট্রোমিয়ারের বিভাজন শুরু হয়।
*নিউক্লিয়ার মেমব্রেন এবং নিউক্লিওলাসের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটে।
•অ্যানাফেজ (Anaphase):
*প্রতিটি ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, ফলে ক্রোমোটিড দুটি আলাদা হয়ে পড়ে।
এ অবস্থায় প্রতিটি ক্রোমোটিডকে অপত্য ক্রোমোজোম বলে এবং এতে একটি করে সেন্ট্রোমিয়ার থাকে।
*অপত্য ক্রোমোজোমগুলো বিষুবীয় অঞ্চল থেকে পরস্পর বিপরীত মেরুর দিকে সরে যেতে থাকে। অর্থাৎ ক্রোমোজোমগুলোর অর্ধেক এক মেরুর দিকে এবং বাকি অর্ধেক অন্য মেরুর দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
*অপত্য ক্রোমোজোমের মেরু অভিমুখী চলনে সেন্ট্রোমিয়ার অগ্রগামী থাকে এবং বাহুদ্বয় অনুগামী হয়।
*সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান অনুযায়ী ক্রোমোজোমগুলো V, L, J বা I-এর মতো আকার ধারণ করে। এদেরকে যথাক্রমে মেটাসেন্ট্রিক সাবমেটাসেন্ট্রিক, অ্যাক্রোসেন্ট্রিক ও টেলোসেন্ট্রিক বলে।
*অ্যানাফেজ পর্যায়ের শেষের দিকে অপত্য ক্রোমোজোমগুলো স্পিন্ডলযন্ত্রের মেরুপ্রান্তে অবস্থান নেয় এবং ক্রোমোজোমের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
•টেলোফেজ (Telophase):
*এটি মাইটোসিসের শেষ পর্যায়। এখানে প্রোফেজের ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে বিপরীতভাবে ঘটে।
*ক্রোমোজোমগুলোতে পানি যোজন ঘটতে থাকে এবং সরু ও লম্বা আকার ধারণ করে। অবশেষে এরা জড়িয়ে গিয়ে নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম গঠন করে।
নিউক্লিওলাসের পুনরাবির্ভাব ঘটে।
*নিউক্লিয়ার রেটিকুলামকে ঘিরে পুনরায় নিউক্লিয়ার মেমব্রেনের সৃষ্টি হয়, ফলে দুই মেরুতে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস গঠিত হয়।
*পিন্ডলযন্ত্রের কাঠামো ভেঙে পড়ে এবং তন্তুগুলো ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়।
*টেলোফেজ পর্যায়ের শেষে বিষুবীয় তলে এন্ডোপ্লাজমিক জালিকার ক্ষুদ্র অংশগুলো জমা হয় এবং পরে এরা মিলিত হয়ে কোষপ্লেট গঠন করে।
সাইটোপ্লাজমিক অঙ্গাণুসমূহের সমবণ্টন ঘটে। ফলে দুটি অপত্য কোষ (daughter cell) সৃষ্টি হয়।
*প্রাণীর ক্ষেত্রে স্পিন্ডলযন্ত্রের বিষুবীয় অঞ্চল বরাবর কোষঝিল্লিটি গর্তের মতো ভিতরের দিকে ঢুকে যায় এ গর্ত সবদিক থেকে ক্রমান্বয়ে গভীরতর হয়ে একত্রে মিলিত হয়, ফলে কোষটি দুভাগে ভাগ হয়ে পড়ে।
ofofofoo
মাইটোসিসের গুরুত্ব (Importance of Mitosis):
*মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় কোষ বিভাজনের কারণে প্রতিটি কোষের নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজমের মধ্যকার আয়তন ও পরিমাণগত ভারসাম্য রক্ষিত হয়। এর ফলে বহুকোষী জীবের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে।
সব বহুকোষী জীবই জাইগোট নামক একটি কোষ থেকে জীবন শুরু করে। এই একটি কোষই বারবার মাইটোসিস বিভাজনের ফলে অসংখ্য কোষ সৃষ্টির মাধ্যমে পূর্ণ জীবে পরিণত হয়।
*মাইটোসিসে তৈরি অপত্য কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা ও গুণাগুণ একই রকম থাকায় জীবের দেহের বৃদ্ধি সুশৃঙ্খলভাবে হতে পারে।
*মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে, মাইটোসিসের ফলে অঙ্গজ প্রজনন সাধিত হয় এবং জননকোষের সংখ্যাবৃদ্ধিতে মাইটোসিস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
*ক্ষতস্থানে নতুন কোষ সৃষ্টির মাধ্যমে জীবদেহের ক্ষতস্থান পূরণ করতে মাইটোসিস অপরিহার্য।
*মাইটোসিসের ফলে একই ধরনের কোষের উৎপত্তি হওয়ায় জীবজগতের গুণগত বৈশিষ্ট্যের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন (Uncontrolled Cell Division):
টিউমার, ক্যান্সার এ শব্দগুলোর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। এগুলো অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনের ফল। মাইটোসিস কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি এভাবে কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু কোষ বিভাজন প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রিত থাকে। কোনো কারণে এই নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে গেলে অস্বাভাবিকভাবে কোষ বিভাজন চলতে থাকে। এর ফলে টিউমার সৃষ্টি হয় এবং প্রাণঘাতী টিউমারকে ক্যান্সার বলে।
ক্যান্সার কোষ এই নিয়ন্ত্রণহীন অস্বাভাবিক কোষ বিভাজনেরই ফল। গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন ধরনের রোগজীবাণু, কেমিক্যাল কিংবা তেজস্ক্রিয়তা ক্যান্সার কোষ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। সহস্রাধিক জিনকে ক্যান্সার কোষ তৈরিতে সহায়ক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসের E6 এবং E7 নামের দুটি জিন এমন কিছু প্রোটিন সৃষ্টি করে, যা কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রক প্রোটিন অণুসমূহকে স্থানচ্যুত করে। এর ফলে কোষ বিভাজনের নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়ে যায় এবং সৃষ্টি হয় জরায়ুমুখের টিউমার। অনেক সময় এ দুটি জিন পোষক কোষের জিনের সাথে একীভূত হয়ে যায় এবং কোষের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী প্রোটিন অণুগুলোর কাজ বন্ধ করে দেয়। সৃষ্টি হয় ক্যান্সার কোষ, কিংবা ক্যান্সার। অনেক ধরনের ক্যান্সার রয়েছে এবং সেগুলো সবই কমবেশি মারাত্মক রোগ। লিভার, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, স্তন, ত্বক, কোলন এবং জরায়ু, অর্থাৎ দেহের প্রায় সকল অঙ্গেই ক্যান্সার হতে পারে।
মিয়োসিস বা হ্রাসমূলক বিভাজন (Meiosis or Reductional Division): মিয়োসিস এক বিশেষ ধরনের কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া যাতে মাতৃকোষের নিউক্লিয়াসটি উপর্যুপরি দুবার বিভাজিত হলেও ক্রোমোজোমের বিভাজন ঘটে মাত্র একবার, ফলে অপত্য কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা অর্ধেক হয়ে যায়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বোধেরী (Bovery) সর্বপ্রথম গোলকৃমির (Round worm) জননাঙ্গে এধরনের কোষ বিভাজন লক্ষ করেন। বিজ্ঞানী সবুর্গার ( Strasburger, ১৮৮৮) সপুষ্পক উদ্ভিদের জনন মাতৃকোষে এরূপ কোষ বিভাজন প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে কারমার (Farmer) (Moore) এ ধরনের কোষ বিভাজনকে মিয়োসিস আখ্যা দেন। গ্রিক Merous (to lessen হ্রাস করা)। যৌন জননকারী জীবের জনন মাতৃকোষ (germ mother cell)-এ সম্পন্ন হয়। এটি সর্বদাই ডিপ্লয়েড (2n) সংখ্যক ক্রোমোজোম বিশিষ্ট কোষে ঘটে থাকে। উচ্চশ্রেণির উদ্ভিদের ক্ষেত্রে এই বিভাজন পরাগধানী এবং ডিম্বকের মধ্যে ঘটে। অপরদিকে প্রাণিদের ক্ষেত্রে এটি জনন অঙ্গ অর্থাৎ শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়ে পরিলক্ষিত হয়।
১. নিম্নশ্রেণির জীবে মিয়োসিসের প্রথম বিভাজনে ক্রোমোজোম সংখ্যা (হ্যাপ্লয়েড) মিয়োসিস হয় নিষেকের পর জাইগোটে জীব অনুযায়ী মিয়োসিসের সময়কাল ভিন্ন হয়। যেমন- হ্রাস ও দ্বিতীয় সমবিভাজনে চারটি অপত্য কোষ সৃষ্টি হয়। ডিপ্লয়েড জীবে মিয়োসিস ঘটে গ্যামেট গঠনের ঠিক পূর্বে, অর্থাৎ যখন শুক্রাণু মাতৃকোষ থেকে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় বা ডিম্বাণু মাতৃকোষ থেকে ডিম্বাণু উৎপন্ন হয়। এই প্রকার মিয়োসিসকে টার্মিনাল (terminal meiosis) বলে।
২. সপুষ্পক উদ্ভিদের ক্ষেত্রে মিয়োসিস পরাগধানীর মধ্যে মাইক্রোস্পোর (microspore) বা পুংরেণু গঠনের সময় এবং ডিম্বাশয়ের মধ্যে মেগাস্পোর (megaspore) বা স্ত্রীরেণু গঠনের সময় ঘটে। এই প্রকার মিয়োসিসকে বলে স্পোরিক (sporic) মিয়োসিস।
৩. কয়েক প্রকার ছত্রাক ও শৈবালের দেহে মিয়োসিস নিষেকের ফলে সৃষ্ট জাইগোট গঠনের পরে ঘটে। এই প্রকার মিয়োসিসকে জাইগোটিক (zygotic) মিয়োসিস বলে।
'মিয়োসিস এর বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Meiosis) :
১. জনন মাতৃকোষ (2n) এর নিউক্লিয়াসে মিয়োসিস ঘটে।
২. মিয়োসিলের সময় হোমোলোগাস ক্রোমোজোমের মধ্যে সিন্যাপসিস ঘটে।
৩. কায়াজমা ও ক্রসিং ওভার ছারা হোমোলোগাস ক্রোমোজোমের নন-সিস্টার ক্রোমোটিভের মধ্যে অংশের বিনিময়ের ফলে নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটে।
৪. মিয়োসিস-১ এর প্রোফেজ জটিল, দীর্ঘস্থায়ী এবং পাঁচটি উপপর্যায়ে বিভক্ত।
৫. মিয়োসিসে ক্রোমোজোম একবার এবং নিউক্লিয়াসের দুই বার বিভাজন ঘটে।
৬. মিয়োসিস-২ এর পর সাইটোকাইনেসিস ঘটে।
৭. একটি ডিপ্লয়েড কোষ থেকে চারটি হ্যাপ্লয়েড কোষের সৃষ্টি হয়।
মিয়োসিস প্রক্রিয়া (Process of Meiosis):
মিয়োসিস বিভাজনের সময় একটি কোষ পর পর দুবার বিভাজিত হয়। প্রথম বিভাজনকে প্রথম মিয়োটিক বিভা বা মিয়োসিস-১ এবং দ্বিতীয় বিভাজনকে দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন বা মিয়োসিস-২ বলে। প্রথম বিভাজনের সময় অ কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হয় তাই একে হ্রাসমূলক বিভা (reduction division) বলে। দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজনটি মাইটোসিসের অনুরূপ।প্রথম মিয়োটিক বিভাজন বা মিয়োসিস-১ (First Meiotic Division) প্রথম মিয়োটিক বিভাজনকে চারটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে, যেমন- প্রোফেজ-১, মেটাফেজ-১, অ্যানাফেজ-১ এবং টেলোফেজ-১। নিচে এদের বর্ণনা দেয়া হলো।
প্রোফেজ-১ (Prophage -1)
এটি মিয়োসিস-১ এর প্রথম পর্যায়। প্রোফেজ শুরু হওয়ার আগেই DNA প্রতিলিপিত হয়, তবে দৃষ্টিগোচর হয় না। প্রথম মিয়োসিস বিভাজনের প্রোফেজ ধাপটি দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল। ঘটনা পরম্পরা অনুযায়ী প্রোফেজ-১ নিচেবৰ্ণিত ৫টি উপপর্যায়ে বিভক্ত।
লেপ্টোটিন (Leptotene গ্রিক, leptos =চিকন বা সরু + tene = সুতা) : এ উপপর্যায়ে নিউক্লিয়ানো আকার বৃদ্ধি পায় ও DNA-র পরিমাণ দ্বিগুণ হয়। নিউক্লিয়াসের জলীয় অংশ কমে যায় এবং নিউক্লিয়ার রেটিকুলাম (ব ক্রোমাটিন তত্ত্বটি) ভেঙ্গে লম্বা প্যাচহীন ও সরু ক্রোমোজোম আত্মপ্রকাশ করে। প্রতিটি ক্রোমোজোম একটি করে ক্রোমাটিড নিয়ে গঠিত এবং এর গায়ে দানাদার ক্রোমোমিয়ার বিন্যস্ত থাকে। নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ও নিউক্লিওলাস সুস্পষ্ট থাকে। এ উপপর্যায়ের শেষ দিকে ক্রোমোজোমগুলো কুণ্ডলীকৃত ও মোটা হতে থাকে। এ উপনশার শেষ দিকে প্রাণিকোষের ক্রোমোজোমগুলো এক প্রান্তে সরে গিয়ে ফুলের তোড়ার আকার ধারণ করে। বিজ্ঞানী ডার্লিংটন এরূপ সজ্জা বিন্যাসকে বোকে স্টেজ (bouquet stage) বলেন।
জাইগোটিন (Zygotene, গ্রিক, zygos = গোড়া + tene ) সমসংস্থ বা হোমোলোগাস (homologous) ক্রোমোজোমগুলো (পিতা ও মাত্রা থেকে আগত একই আকৃতি ও একই জিনের সজ্জারীতি সম্পন্ন ক্রোমোজোমদুটিকে সমসংস্থ বা হোমোলোগাস ক্রোমোজোম বলে) পাশাপাশি অবস্থান করে। এগুলোকে বাইভ্যালেন্ট (bivalent) বলে। হোমোলোগাস ক্রোমোজোমের জোড় বাঁধার এ প্রক্রিয়াকে সাইন্যাপসিস (synapsis) বলা হয়। অবিরাম কুন্ডলী পাকানোর ফে ক্রোমোজোমগুলো মোটা ও খাটো দেখায়। নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ও নিউক্লিওলাস অবিকৃত থাকে। প্রাণিকোষের ক্ষেত্রে সেন্ট্রিওলে বিভক্তির সূচনা ঘটে।
প্যাকাইটিন (Pachytene, গ্রিক, pachys পুরু+ lene সুতা) এ ধাপে ক্রোমোজোমগুলো আরও খাটো ও মোটা হয়। প্রতিটি ক্রোমোজোম সেন্ট্রোমিয়ার ছাড়া লম্বালম্বিভাবে দ্বিখণ্ডিত হয়ে। দুটি করে ক্রোমাটিড গঠন করে। এর ফলে প্রতিজোড়া হোমোলোগাস রোমোজোম থেকে ৪টি করে ক্রোমাটিড সৃষ্টি হয়। এ অবস্থাকে টেট্রাড (tetrad) বলে। একই ক্রোমোজোমের ক্রোমাটিডদুটিকে সিস্টার ক্রোমাটিড (sister chromatid), অন্যদিকে, বাইভ্যালেন্টের ভিন্ন ভিন্ন ক্রোমোজোমের ক্রোমাটিডগুলোকে নন-সিস্টার ক্রোমাটিড বলা হয়। ক্রোমোজোমগুলো লম্বালম্বিভাবে আরও সংকুচিত হয় এবং মোটা দেখায়। হোমোলোগাস ক্রোমোজোমগুলোর মধ্যে আকর্ষণ ক্ষমতা কমে যায় এবং তার পরিবর্তে বিকর্ষণ ক্ষমতার উদ্ভব ঘটে, ফলে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরতে থাকে। হোমোলোগাস ক্রোমোজোমগুলো সম্পূর্ণ আলাদা হতে পারে না। কারণ নন-সিস্টার ক্রোমাটিডের মাধ্যমে এক বা একাধিক স্থানে যুক্ত থেকে ইংরেজী X আকারের মতো কায়াজমা (chiasma, বহুবচন chiasmata) সৃষ্টি করে। দুটি কায়াজমার উপস্থিতিতে বাইভ্যালেন্ট একটি ফাঁ (loop) গঠন করে। কায়াজমা অংশে ক্রোমাটিডগুলো এডোনিউক্লিয়েজ এনজাইমের প্রভাবে ভেঙ্গে যায়। আবার সাথে সাথেই লাইগেজ এনজাইমের প্রভাবে জোড়া লেগে যায়। জোড়া লাগার সময় একটি ক্রোমাটিডের ভাঙ্গা অংশ অন্য ক্রোমাটিডের একই স্থানে ভাষা অংশে যুক্ত হয়। নম- সিস্টার ক্রোমাটিডের এ ধরনের অংশ সিস্টার জোমাটিড নন-সিটার ক্রোমাটিড - সিমটার কোমাটিড বিনিময়কে ক্রসিং ওভার (crossing over) বলে । ,
ডিপ্লোটিন (Diplotene গ্রিক, diples = double tene সুতা) ক্রমাগত সংকোচনের ফলে ক্রোমোজোমগুলো এ উপপর্যায়ে আরও খাটো ও মোটা হয়। বাইভ্যালেন্টের ক্রোমোজোমদুটির মধ্যে পারস্পরিক বিকর্ষণ শুরু হয়। এরা বিপরীত দিকে সরে যেতে চেষ্টা করে। কিন্তু কায়াজমাটার স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই বিকর্ষণ একই সাথে কয়েক স্থানে শুরু হতে পারে। তবে সাধারন সেন্ট্রোমিয়ারদুটির মধ্যেই প্রথম ও বেশি বিকর্ষণ শুরু হয়। | বিকর্ষণের ফলে দুটি কায়াজমাটার মধ্যবর্তীস্থানে লুপের | (ফাঁস) সৃষ্টি হয়। কায়াজামাটা ক্রমান্বয়ে প্রান্তের দিকে সরে যেতে থাকে। কান্নাজমার এরূপ প্রান্তের দিকে সরে যাওয়াকে প্রাতীয়করণ (terminalisation) বলে। দুই বা ততোধিক বাহু পরস্পর আবর্তনের ফলে পাশাপাশি লু কোনে থাকে। একটি মাত্র কায়াজমা থাকলে এটি ১৮০ হতে পারে।
ডায়াকাইনেসিস (Diakinesis, গ্রিক, dia অপর পাশে + kinesis সমাবেশ) : এ উপপর্যায়ে ক্রোমোজোমগুলো আরও খাটো ও মোটা হয়। প্রান্তীয়করণ তখনও চলতে থাকে। বাইভ্যালেন্টের প্রতিটিক্রোমোজোমের উপর ধাত্র (matrix) জমা হয় বলে তখন ক্রোমাটিডে আর বিভক্তি দেখা যায় না। এক সময় বাইভ্যালেন্টগুলো নিউক্লিয়াসের কেন্দ্রস্থল থেকে পরিধির নিকে চলে আসে। এ উপপর্যায়ের শেষ দিকে নিউক্লিওলাস অদৃশ্য হয়ে যায়, নিউক্লিয়ার মেমব্রেনের অবলুপ্তি ঘটে এবং সেন্ট্রিওল (প্রাণিকোষে) মেরুতে পৌঁছে যায়।
মেটাফেজ-১ঃ এ ধাপে নিউক্লিয়ার মেমব্রেন বিলুপ্ত হয়। দুইমেরুবিশিষ্ট স্পিন্ডলযত্নের (মানুযন্ত্রের) আবির্ভাব ঘটে। বাইভ্যালেন্টগুলো মাকুর নিরক্ষীয় গুলের দিকে ধাবিত হয়। ক্রোমোজোমগুলো সেন্ট্রোমিয়ারের সাহায্যে স্পিডলের আকর্ষণ তন্তুর সাথে যুক্ত হয়। ক্রোমাটিডগুলো কায়াজমা প্রান্তে যুক্ত থাকে এবং আরও খাটো ও মোটা হয়।
অ্যানাফেজ-১ঃ মিয়োসিস বিভাজনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দশা। এ ধাপে কায়াজামাটা ভেঙ্গে বাইভ্যালেন্টের সমসংস্থ ক্রোমোজোমনুটি পৃথক হয়ে বিপরীত মেরুতে ধাবিত হয়। এ সময় সেন্ট্রোমিয়ারগুলো সবসময় আগামী এবং বাহুগুলো পশ্চাৎগামী থাকে। মাকৃতত্ত্বর বিষুবীয় অঞ্চলের প্রসারণ, ক্রোমোজোমের অন্তর্নিহিত গতিশক্তি এবং সেন্ট্রোমিয়ারের বিকর্ষণ শক্তির সম্মিলিত ক্রিয়ায় ক্রোমোজোমের মেরুমুখী চলন সম্পন্ন হয়। ক্রোমোজোমগুলো ইংরেজি V. I, I বা J অক্ষরের মতো আকার ধারণ করে। অ্যানাফেজ পর্যায়ের শেষ দিকে ক্রোমোজোমগুলো প্রতিটি মেরুতে পৌঁছায়। ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার বিভক্ত না হওয়ায় ক্রোমোজোমের ডিপ্লয়েড (Zn) সংখ্যা হ্যাপ্লয়েড (n) পরিণত হয় ফলে কোষের প্রতি মেরুতে যেসব ক্রোমোজোম পৌঁছায় তার সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেক হয়ে যায়।
টেলোফেজ-১ঃ এটি মিয়োসিস-১ এর শেষ ধাপ। এ ধাপে দুই মেরুতে পুঞ্জিভূত ক্রোমোজোমেগুলোর চারদিকে নিউক্লিয়ার মেমব্রেন সৃষ্টি হয়ে দুটি হ্যাপ্লয়েড অপত্য নিউক্লিয়াস গঠন করে এবং নিউক্লিওলাসের আবির্ভাব ঘটে। এ সময় ক্রোমোজোমগুলো পানি গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে সরু ও লম্বা হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। টেলোফেজের শেষ দিকে প্রজাতিভেদে মাইটোসিস প্রক্রিয়ার মতো সাইটোকাইনেসিস ঘটে অথবা ঘটে না।
মিয়োসিস-১ প্রক্রিয়া শেষে যে দুটি নিউক্লিয়াস বা কোষের সৃষ্টি হয় তা স্বল্প সময়ের মধ্যে মিয়োসিস-২ অধ্যায় সূচ করার জন্য মধ্যবর্তী সময় অতিবাহিত করে। এ সময় কিছু প্রয়োজনীয় RNA ও প্রোটিন সংশ্লেষিত হয়, DNA প্রতিরূপ সৃষ্টি হয়না। এ অন্তবর্তীকালীন সময়কে ইন্টারকাইনেসিস বলে। প্রাণিকোষের ক্ষেত্রে সেন্ট্রিওল জোড়ায় পুনর্বার বিভাজন ঘটে।
দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন (Second Meiotic Division) প্রথম মিয়োটিক বিভাজনে সৃষ্ট হ্যাপ্লয়েড মাতৃকোষ বা নিউক্লিয়াসদুটি যে প্রক্রিয়ায় ৪টি হ্যান্ড্রয়েড (a) কোষ নিউক্লিয়াস গঠন করে, তাকে দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজন বলে। এ বিভাজনকে ৪টি ধাপে ভাগ করা হয়েছে।
১. প্রোফেজ-২ (Prophase 11) দুটি ক্রোমাটিকসহ
ক্রোমোজোমগুলো পাক খেষে খাটো ও মোটা হয়। ক্রোমাটিডগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। প্রথম নিয়োটিক বিভাজনের সমকোণে স্পিডলযন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে। প্রোফেজ-২ এর শেষদিকে নিউক্লিওলাস ও নিউক্লিয়ার মেমব্রেন বিলুপ্ত হয়।
২. মেটাফেজ-২ (Metaphase 11) ক্রোমোজোমগুলো নিরক্ষ রেখা বানর বিন্যস্ত হয়। সেন্ট্রোমিয়ারগুলো নিরক্ষনে এবং ক্রোমাটিড গুলো মেরুপ্রান্তে প্রসারিত হয়। প্রতিটি ক্রোমোজোমের সেন্ট্রোমিয়ার বিভক্ত হয়ে দুটি করে অপতা ক্রোমোজোমের সৃষ্টি করে। পিছনের আকর্ষণপুর সাহায্যে সেন্ট্রোমিয়ারের মাধ্যমে ক্রোমোজোমগুলো যুক্ত থাকে।
৩. অ্যানাফেজ-২ (Anaphase 11) সেন্ট্রোমিয়ারের পূর্ণ বিভক্তিরা ফলে প্রত্যেক ক্রোমোজোমের দুটি ক্রোমাটিক সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায় এবং আকর্ষণ অন্তুর সংকোচনে ধীরে ধীরে বিপরীত মেরুতে পৌঁছায়। মেরুমুখী সনকালে সেন্ট্রোমিয়ারের অবস্থান অনুযারী কোমাটি V.1... এবং আকতির দেখায়।
৪. টেলোফেজ-২ (Teleophase II) : মেরুপ্রান্তে পৌঁছায়। ক্রোমোজোমগুলোর কুগুলি খুলতে থাকে এরা লম্বা সরু সুতার মতো আকার ধারণ করে। পানি সম্পৃক্ত হওয়ায় এগুলো অদৃশ্য হয়। নিউক্লিয়ার মেমব্রেন ও নিউ না। এভাবে প্রতিটি মাতৃ নিউক্লিয়াস দুটি অপত্য নিউক্লিয়াসে পরিণত হয়ে মোট ৪টি অগতা নিউক্লিয়াস সৃষ্টি করে।
সাইটোকাইনেসিস (Cytokinesis): আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোন কোন ভাবে প্রথম মিয়োটিক বিভাজনের পর পর সাইটোপ্লাজমের বিভক্তির ফলে দুটি অপত্য কোষের সৃষ্টি হয় অথবা সাইটোকাইনেসিস তখন না হয়ে দ্বিতীয় ঘাট বিভাজনের পর সাইটোপ্লাজমের বিভাজন ঘটে, ফলে এটি অপত্য কোষের সৃষ্টি হয়।
ক্রসিং ওভার (Crossing Over):
মায়োসিস-১ এর প্যাকাইটিন উপ-পর্যায়ে এক জোড়া সমসংস্থ ক্রোমোসোমের দুটি নন-সিস্টার ক্রোমাটিড-এর মধ্যে বিনিময় হওয়াকে ক্রসিং ওভার বলে। ক্রসিং ওভারের ফলে ক্রোমোসোমের জিনসমূহের মূল বিন্যাসের পরিবর্তন ঘটে এবং লিঙ্কড জিনসমূহের মধ্যে নতুন সমন্বয় (combination) তৈরি হয়।
ক্রসিং ওভারের কৌশল :
মিয়োসিস -১ এর প্রোফেজের জাইগোটিন উপপর্যায়ে ক্রোমোজোম পারস্পরিক জোড় বাধে একে সিইন্যাপসিস বলে। প্রতিটি জোড়ার নাম বাইভ্যালেন্ট।
*প্রথমে দুটি নন-সিস্টার ক্রোমাটিড একই স্থান বরাবর ভেঙে যায় (Endonuclease এনজাইম এর কারণে) এবং দুটি সিস্টার ক্রোমাটিড গঠন করে। প্রতিটি বাইভ্যালেন্টে ৪ টি ক্রোমাটিড সৃষ্টি হয় একে টেট্রোড বলে।
*পরে একটি সাথে অপরটির অন্য অংশ পুনরায় জোড়া লাগে ligase এনজাইমের প্রভাবে। ফলে কায়াজমা (X আকৃতি) সৃষ্টি হয়।
*শেষ পর্যায়ে প্রান্তীয়করণের মাধ্যমে ক্রোমাটিডের বিনিময় শেষ হয়। ক্রসিং ওভারের ফলে *ক্রোমাটিডের মধ্যে অংশের বিনিময় ঘটে, সাথে সাথে জিনেরও বিনিময় ঘটে (যেহেতু জিন ক্রোমোসোমেই বিন্যস্ত থাকে)। জিন-এর বিনিময়ের ফলে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বিনিময় হয়, ফলে জীবে চারিত্রিক পরিবর্তন ঘটে।
ক্রসিং ওভারের গুরুত্ব বা তাৎপর্যঃ
কিছু সংখ্যক নিম্নশ্রেণির জীব ছাড়া সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে ক্রসিং ওভার ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। ক্রসিং ওভারের গুরুত্ব নিচে উল্লেখ করা হলো :
*ক্রসিং ওভারের ফলে দুটি ক্রোমাটিডের মধ্যে অংশের বিনিময় ঘটে, ফলে জিনগত পরিবর্তন সাধিত হয়।
*জিনগত পরিবর্তন সাধনের ফলে সৃষ্ট জীবে বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন সাধিত হয়।
*বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্টিকুলে আসে বৈচিত্র্য, সৃষ্টি হয় নতুন পরিবেশে টিকে থাকার ক্ষমতা, আবার কখনো সৃষ্টি হয় নতুন প্রজাতি।
*ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত উন্নত বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট নতুন প্রকরণ সৃষ্টি করা যায়। এভাবেই ফসলি উদ্ভিদের ক্রমাগত উন্নতি সাধন করা হয়।
*কৃত্রিম উপায়ে ক্রসিং ওভার ঘটিয়ে বংশগতিতে পরিবর্তন আনা সম্ভব। কাজেই প্রজননবিদ্যায় ক্রসিং ওভারের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।
*গবেষণার ক্ষেত্রেও ক্রসিং ওভারের গুরুত্ব রয়েছে। কারণ, ক্রোমোসোমে জিনের রেখাকার বিন্যাস প্রমাণে বা ক্রোমোসোম ম্যাপিং-এ ক্রসিং ওভার বৈশিষ্ট্য ব্যবহৃত হয়।
*জেনেটিক ম্যাপ তৈরি করা ও ক্রোমোসোমে জিনের অবস্থান নির্ণয়।